যেকোনো দেশের এভিয়েশন খাতের উন্নয়ন নির্ভর করে দেশটির সিভিল এভিয়েশন অথরিটির নীতিমালাগুলো কতটা নমনীয় তার ওপর। দেশের এভিয়েশন খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) খুবই ভালো কাজ করছে। তবে তাদের বিমান পরিবহন নীতিমালা আরও উদার হতে পারে।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন ইথিওপিয়ান সিভিল এভিয়েশন অথরিটির মহাপরিচালক গেটাচিউ মেনগিস্টি আলেমায়েহু।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। একটি দেশের এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে নিতে দেশটির সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালা কেমন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বেবিচকের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। বেবিচক খুবই ভালো কাজ করছে। তবে আরও ভালো করার সুযোগ সবসময়ই থেকে যায়। সেক্ষেত্রে বিমান পরিবহন নীতি আরও উদার (লিবারেল) হতে পারে। এতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসা আরও সমৃদ্ধ হবে, একইভাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ বাড়বে।
ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে ১৫২টি বিমান রয়েছে। অর্থনীতির মানদণ্ডে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’র একটি এয়ারলাইন্স আফ্রিকার সর্ববৃহৎ বহরের অধিকারী কীভাবে হলো? জানতে চাইলে গেটাচিউ মেনগিস্টি আলেমায়েহু বলেন, ইথিওপিয়ার এভিয়েশন খাত নব্বই দশকের দিকে আত্মপ্রকাশ করে। সেসময় বিশ্বের খুব অল্প দেশেই এই খাত জনপ্রিয় ছিল। ফ্লাইটের সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করার কারণেই ইথিওপিয়ায় এই শিল্পটি এতদূর এগিয়েছে।
বাংলাদেশ সফরকালে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করেছেন ইথিওপিয়ান সিভিল এভিয়েশন ডিজি। আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, দুই দেশের বিমান পরিবহন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমর উভয়ই বিমান চলাচল ও সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করি। ইথিওপিয়ায় এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদানের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাইলটসহ এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা এখানে এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আমরা বাংলাদেশের পাইলটসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছি। এছাড়াও অডিট ইন্সপেকশন, পারস্পারিক দক্ষ অডিটর বিনিময়, বাংলাদেশ রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং একাডেমিক সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) সম্পাদনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়।
‘ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বহরে ২০টি বোয়িং ৭৩৭-ম্যাক্স এয়ারক্রাফট রয়েছে। ম্যাক্স সিরিজের এই বিমানটি দিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন, লায়ন এয়ার ও ইথিওপিয়ান এয়ার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বিশ্বের অনেক দেশ এই এয়ারক্রাফট গ্রাউন্ডেড করে দেয়। এমনকি দুর্ঘটনার কারণে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন, লায়ন এয়ারের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে দুর্ঘটনার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।’
কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ফ্লাইট পরিচালনার আগে যাত্রীর ফ্লাইট সেফটি ও সিকিউরিটির দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনার পর অধিকতর তদন্ত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্ঘটনার কারণ এয়ারলাইন্স, পাইলট বা সংশ্লিষ্ট কেউ নন। আমরা তারপরও আমরা ত্রুটি সারিয়ে, নতুন ও রিভাইজড ৭৩৭-ম্যাক্স গ্রহণ করি। এরপরই শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ম্যাক্স দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করি।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে আফ্রিকার দেশ আদ্দিস আবাবায় সরাসরি ফ্লাইট চালু করেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। এই রুটে বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট দিয়ে বর্তমানে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা।
ইথিওপিয়ার এই ফ্লাইট চালুতে দু-দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ঢাকা পোস্টের কথা হয় ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের আঞ্চলিক পরিচালক সলোমন বেকেলের সঙ্গে।
ফ্লাইটটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এই ফ্লাইট চালুর মাধ্যমে দুই দেশের সুসম্পর্ক নতুন মাত্রা পেল। ফ্লাইট চালুর ফলে দু-দেশের আমদানি-রপ্তানি আরও সহজতর হবে। আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতেও বাংলাদেশিদের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণ সহজ হবে। এছাড়াও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্প অনেক বড় ও স্বনামধন্য। আমরা এসব সেক্টরের ব্যবসায়ীদের নিয়ে ইথিওপিয়ায় বিজনেস কমিউনিটি করতে চাই।
বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে সলোমন বেকেল বলেন, ইথিওপিয়ায় খুবই স্ট্রং এভিয়েশন ট্রেনিং একাডেমি রয়েছে, সিমুলেটর রয়েছে। সারাবিশ্ব থেকে অনেকে আসে এখানে ট্রেনিং নিতে। আমরা বাংলাদেশি পাইলটদের ট্রেনিং দেওয়ার বিষয়ে ভাবছি। আমরা ইতোমধ্যে বেবিচকের সঙ্গে কথা বলেছি।
বাংলাদেশে ফ্লাইট বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ঢাকা রুটে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট চালাচ্ছি। যাত্রীদের ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। তাছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতে ২৫ লাখের মতো বাংলাদেশি থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি ওমরাহ হজে যায়। আমরাও ওমরাহযাত্রী বহন করতে আগ্রহী। যাত্রীদের এই সাড়া অব্যাহত থাকলে আমরা শিগগিরই সপ্তাহে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করতে চাই।
বাংলাদেশি যাত্রী বহনে মধ্যপ্রাচ্যের বিমানগুলোর একক আধিপত্যে ইথিওপিয়া টিকতে পারবে কি না, জানতে চাইলে সলোমন বেকেল বলেন, আমরা বিভিন্ন রুটেও তার্কিশ এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, সৌদি এ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা করে ফ্লাইট পরিচালনা করছি। এটা নতুন কিছু না। আমরা জানি কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হয়। আমরা আমাদের সেবা ও ফ্লাইট সেফটি নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমরা প্রতিযোগিতার কৌশল জেনেই ঢাকায় ফ্লাইট শুরু করেছি। পাশাপাশি ঢাকায় আমাদের একটি ডায়নামিক টিম কাজ করছে। আমরা যাত্রীদের জন্য সহনীয় টিকিটের দাম রাখতে চাই, অতিরিক্ত ব্যাগেজ ও সেরা সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজার ধরতে চাই।