লন্ডন : বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি ছিল এয়ারলাইনস খাত। মহামারী-পরবর্তী এয়ারলাইনস ব্যবসায় বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা যায়। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর রাতারাতি আকাশপথে ভ্রমণের চাহিদা বেড়ে যায়, যাকে এয়ারলাইনস শিল্পে ‘রিভেঞ্জ ট্রাভেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু সে অবস্থা থিতু হয়ে আসার পর এখন আবার কমে আসছে আকাশপথে চলাচলের চাহিদা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন স্থানীয় অর্থনীতির সমস্যা। সব মিলিয়ে এ খাতজুড়ে আবারো বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
২০২৩ সালে রায়ানএয়ার থেকে এমিরেটসের মতো বিশ্বের নামি কোম্পানিগুলো রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছিল। জ্বালানি, কর্মী ও এয়ারক্রাফট বাবদ খরচ বাড়লেও যাত্রী চাহিদা ও টিকিটের উচ্চ দামের কারণে কোম্পানিগুলো লাভবান ছিল ওই সময়। কিন্তু গত সপ্তাহে রায়ানএয়ার এক বার্তায় জানিয়েছে, চলতি গ্রীষ্মে টিকিটের দাম অনেক কম হতে পারে।
এ বিষয়ে ইউরোপের বৃহৎ এয়ারলাইন কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল ও’লেরি জানান, প্রত্যাশার চেয়ে দুর্বল ভোক্তা ব্যয়ের কারণে যাত্রী পেতে হিমশিম খাচ্ছে রায়ানএয়ার। টিকিটের দাম বাড়ানোর কোম্পানির সাম্প্রতিক চেষ্টা যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে।
করোনা লকডাউন শেষে যাত্রীরা ভ্রমণের জন্য মরিয়া ছিলেন। তাই উচ্চ ভাড়া সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন রুটে বেড়েছে ফ্লাইট। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোয় আসন অনুসারে যথেষ্ট যাত্রী পেতে উড়োজাহাজ পরিষেবাদাতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই টিকিটের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছে অনেক কোম্পানি।
এ বিষয়ে তুরস্কের পেগাসাস এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী গুলিজ অজতুর্ক বলেন, ‘যাত্রীরা পুরনো ধারায় ফিরে এসেছেন। মহামারী-পরবর্তী রিভেঞ্জ ট্রাভেল শেষে স্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত আমাদের।’
এয়ার ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাম্পবেল উইলসনের মতে, কভিড-পরবর্তী সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা ছিল। এরপর এয়ারলাইনস শিল্পে যাত্রী চাহিদার ধরনগুলো যথানিয়মে স্বাভাবিক হতে চলেছে।
এদিকে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশকালে সম্প্রতি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম এয়ারলাইন ইজিজেট জানায়, এ গ্রীষ্মে টিকিটের দাম স্থিতিশীল থাকবে। ইজিজেটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ফ্লাইট নিয়ে ইউরোপীয় বাজারে শীর্ষ স্থানে রয়েছে রায়ানএয়ার। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, আইরিশ এয়ারলাইনসটির অতিরিক্ত মূল্যছাড় স্বল্প দূরত্বের বাজারে অন্যদেরও অনুসরণ করতে বাধ্য করবে।৷তবে রায়ানএয়ার ও ইজিজেটের পূর্বাভাসের বৈপরিত্য দেখে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, ইউরোপের দুটি বৃহত্তম এয়ারলাইনের পূর্বাভাসের এ মাত্রার ব্যবধান অস্বাভাবিক।
উত্তর আমেরিকার এয়ারলাইনসও আসন ভর্তি করতে টিকিটের দাম অনেক কমিয়েছে। এয়ার কানাডা এরই মধ্যে নেতিবাচক পরিবেশ দেখে পূর্বাভাসে মুনাফার অংক কমিয়েছে। কম দামে পরিষেবা দেয়- এমন সংস্থা স্পিরিট এয়ারলাইনস মে মাসে সতর্ক করে বলেছিল, মার্কিন অভ্যন্তরীণ বাজারে পরিবহন সক্ষমতা বাড়ার পর তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত মুনাফার ওপর ‘উল্লেখযোগ্য চাপ’ অব্যাহত থাকবে।
ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের শীর্ষ আর্থিক কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু নোসেলা গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ফ্লাইট চাহিদা শক্তিশালী রয়েছে। তবে খালি থাকা আসনের হার বাড়ায় টিকিটের দাম কমাতে হয়েছে।
সম্প্রতি লন্ডনের ফর্নবোরায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বের বৃহত্তম এয়ার শো। এর আগেই রায়ানএয়ারের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪৬ শতাংশ মুনাফা হারানোর ঘোষণা আসে। তবে ইভেন্টে আসা অনেক এয়ারলাইনসের শীর্ষ নির্বাহীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানান, তারা এ ধাক্কা সামলাতে পারবেন।
ভার্জিন আটলান্টিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাই ওয়েস জানালেন, অঞ্চল ও আসনভেদে চাহিদার ভিন্নতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আটলান্টিক অঞ্চলের রুটগুলোয় আকাশপথের চাহিদা প্রবল রয়েছে, বিশেষ করে প্রিমিয়াম কেবিন ও মার্কিন গ্রাহকদের কাছে চাহিদা বেশি।’
শাই ওয়েস জানান, যুক্তরাজ্যের বাইরে তৃতীয় প্রান্তিকে কিছুটা দুর্বল চাহিদার আশঙ্কা করছেন। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অনিশ্চয়তা, সরকার পরিবর্তন এ ধরনের ঘটনাগুলো এয়ারলাইনস খাতে প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্যারেন্ট আইএজির প্রধান নির্বাহী লুইস গ্যালেগো জানান, গত প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ইউরোপীয় গন্তব্যগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক রুটে মুনাফা কম ছিল, তবে তা প্রাক-মহামারী স্তরের ওপরে ছিল।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্প দূরত্বের রুট এবং ইকোনমি ক্লাসে চাহিদা কমলেও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দীর্ঘ ট্রিপ ও ব্যয়বহুল ফ্লাইট বা প্রথম শ্রেণীর যাত্রীসংখ্যা খুব একটা প্রভাবিত হয়নি। এ কারণে এয়ারলাইনসগুলো আত্মবিশ্বাসী যে ভ্রমণের চাহিদা এখনো স্থিতিশীল যা ২০১৯ সালের চেয়ে বিমান ভাড়া বেশি রাখতে ও আয় বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।
এদিকে বিশ্বের বৃহত্তম উড়োজাহাজ নির্মাতা এয়ারবাসের বাণিজ্যিক বিমান বিভাগের প্রধান নির্বাহী ক্রিশ্চিয়ান শেরার স্বীকার করেছেন যে সংস্থাটি মুনাফায় কিছুটা হ্রাসের কিছু লক্ষণ” দেখেছে। তবে এটি শ্লথ অর্থনীতি বা কাঠামোগত সমস্যা কিনা তা এখনো বলা যাচ্ছে না।