বাংলাদেশের বিমানসেবার ক্ষেত্রে আরেকটি ‘বিস্ময়কর’ ঘটনা ঘটেছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিমানকে। কিন্তু শুরুতে এমন কথা ছিল না। ফলে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
বিমানবন্দর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণকাজের একটি অংশ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের পর পথ দেখিয়ে পার্কিং বেতে নেওয়া, দরজায় সিঁড়ি লাগানো, যাত্রীদের মালামাল ওঠানো-নামানো, উড়োজাহাজের ভেতর পরিষ্কার করা, চেকইন কাউন্টারে সেবার মতো কাজ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর ঢাকা বিমানবন্দরের যত অভিযোগ, তা মূলত বিমানের এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে।
অপেশাদার ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং, লাগেজ কাটা ও চুরি, মানহীন চেকইন ও চেকআউট সার্ভিস, ইমিগ্রেশনে অদক্ষ সেবা ও সময়ক্ষেপণ, সোনা ও মাদক চোরাচালান, প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি ও ঘুষ, জাল ভিসার চক্র, গোয়েন্দা হয়রানি, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত লাগেজ বহনের চক্র ইত্যাদি আমাদের বিমানবন্দরের নিয়মিত সমস্যা। তা ছাড়া ইচ্ছা করে প্রবেশফটক বন্ধ রেখে এক বা দুটি স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে শত শত যাত্রীকে লম্বা লাইনে রাখা ও টিকেটিং-সংক্রান্ত সেবাও অপ্রতুল।
নতুন তৃতীয় টার্মিনালেও এসব সমস্যা যদি থেকে যায়, তাহলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতি পাঁচ বছরে অন্তত চার বছর বিমান লোকসানে থাকে, লোকসান শতকোটি থেকে হাজার কোটি পর্যায়ে। লিজে আনা উড়োজাহাজ, টিকিট বিক্রি ও বুকিং নিয়োগে স্বার্থবিরোধী চুক্তি, চোরাচালান এবং অপারেশন দুর্নীতিতে লোকসান হাজার কোটি টাকা। ঢাকা বিমানবন্দরের চার্জ এশীয় অঞ্চলে প্রায় সর্বোচ্চ বলে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বেশি। তবে এর একটা পরোক্ষ কারণ আছে, সেটা হচ্ছে আসা ও যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টা অনেক লম্বা, গ্রাউন্ড সার্ভিস খারাপ বলে এয়ারক্রাফট দ্রুত অফলোড করে আবার যাত্রী লোড করে ফিরে যেতে পারে না।
২০২৩ সালে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) অধীনে একটি জাপানি কনসোর্টিয়ামের দ্বারা পরিচালিত হবে। অথচ হঠাৎ করেই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করবে বিমান। তবে বিমান যদি এই দুই বছরের মেয়াদে প্রত্যাশিত ফলাফল দেখাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কোনো সুনাম থাকা কোম্পানিকে দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে যুক্ত করা হবে। অন্য কোনো কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে হলে সুনাম বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু বিমানকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কি বিমানের সুনাম বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল না? বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন সাবেক প্রধান স্পষ্ট বলেছেন যে তৃতীয় টার্মিনালের সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার কার্গো হ্যান্ডলিং করার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের কারও নেই। বিমানবন্দরগুলোতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস পরিচালনা করতে এয়ার নেভিগেশন অর্ডার (এএনও) সার্টিফিকেট নেই বিমানের। ২০১৮ সালে এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হলেও এএনও সার্টিফিকেশন ছাড়াই অপেশাদার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করছে বিমান।
এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে একাধিপত্য বিমানের কিছু মানুষের জন্য লাভজনক হলেও যাত্রীদের দুর্ভোগ থাকবে অব্যাহত। জাপানি ঋণে তৈরি হয়েছে এই টার্মিনাল। এখান থেকে দক্ষতার সঙ্গে অর্থাগম না হলে সেই ঋণ শোধ করা হয়ে যাবে একটি বোঝা। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং যদি প্রমাণিত অদক্ষ ও অসৎ ব্যক্তিদের হাতে পড়ে, তাহলে হিতে বিপরীত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট করে বলতে হয় যে বাংলাদেশ বিমানকে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বোত্তম সেবা ও আয় নিশ্চিত করতে একাধিক দক্ষ পরীক্ষিত সেবা প্রদানকারী সংস্থাকে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হোক।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয়, ২৪ নভেম্বর ২০২৪