ঢাকাঃ বাংলাদেশীদের জন্য সাময়িকভাবে ভিসা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তবে এটি সুনির্দিষ্টভাবে কর্মীদের জন্য নাকি সব বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা। তবে সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধ করে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তারা।
দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আরব আমিরাতের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ওই বিক্ষোভের দায়ে সোমবার (২২ জুলাই)৫৭ বাংলাদেশীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে ইউএই সরকার। এর একদিন পরই মঙ্গলবার (২৩ জুলাই)বাংলাদেশীদের জন্য সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দিল দেশটি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ভিসা বন্ধের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে হয়তো আজ বুধবার (২৪ জুলাই) বিস্তারিত জানা যাবে।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বাংলাদেশী প্রবাসীদের বিক্ষোভের পর সেখানকার কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করতে পারেন; এখান থেকে নতুন করে কর্মী গেলে সেখানে পরিস্থিতি অশান্ত হতে পারে। এ অবস্থায় সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভিসা বন্ধের খবর পাওয়ায় প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশে নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করেছেন। দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, আরব আমিরাতে বাংলাদেশীরা বিক্ষোভ করায় সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধ করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তারা লিখিতভাবে কিছু জানায়নি। মৌখিকভাবে বিষয়টি মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে।’
প্রসঙ্গত, আরব আমিরাতে বিক্ষোভের দায়ে কারাদণ্ড পাওয়া ৫৭ বাংলাদেশীর মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৫৩ বাংলাদেশীর ১০ বছর করে এবং একজনের ১১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আরব আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে গত ১৯ জুলাই ইউএইর বিভিন্ন সড়কে নেমে আন্দোলন করে দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশীরা। এ সময় তারা বিক্ষোভের পাশাপাশি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়ায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেয়া এসব বাংলাদেশীর সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। ইউএইতে বিদেশী শ্রমিকের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগে রয়েছে শুধু ভারত ও পাকিস্তান। আর মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের গন্তব্য হিসেবে ইউএইর অবস্থান দ্বিতীয়।
উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে বিক্ষোভ, শাসক দলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, সমালোচনা বা কোনো বক্তৃতা দেয়ার ক্ষেত্রে আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। এছাড়া সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি এবং এসব কাজে উৎসাহ দেয়া এমনকি ব্যক্তিগতভাবে অথবা প্রকাশ্যে মানহানি বা অপমানজনক বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরব আমিরাতের সঙ্গে সংযোগ আরো জোরালো হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসী হিসেবে ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমিরাতে গেছেন আড়াই লাখেরও বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশের তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল ইউএই। ওই বছর আমিরাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪৩ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে ২০৭ কোটি ১৮ লাখ ডলারে নেমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩২৭ কোটি ৭ লাখ ডলার। যেখানে একই সময়ে প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে এসেছে ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।
দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ী এখন দুবাইয়ে অনানুষ্ঠানিক অফিস খুলে সেখান থেকে ব্যবসা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অতীতে দেশের বিত্তবানদের কাছে দুবাইয়ের আকর্ষণ ছিল নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ আকর্ষণ রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন তারা। আরব আমিরাতও এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিদেশী ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলে-ফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশী ধনিক শ্রেণীর অনেকেই আমিরাতের দেয়া এ সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি এমন অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। আর দুবাইয়ের এ গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের।